Sunday, October 2, 2016

(১)
পুজোর সাহিত্য
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য
দুর্গাপুজোয় পূজাবার্ষিকী হাতে পেলে কার না আনন্দ হয়? আজ যখন সারা বছরই সাহিত্যের নানা পসরা নানা মাধ্যমে আমাদের কাছে আসে, তখনও পুজোর লেখা অন্য সব আনন্দের বাইরে এক অপূর্ব স্বাদ বয়ে আনে। পুজোর লেখার সঙ্গে যেন মিশে থাকে ছুটির আনন্দ, লেখাপড়া থেকে ক্ষণিক মুক্তির এক ঝলক তাজা বাতাস। বাঙালির পুজোর আনন্দের তাই নানা দিশা, নানা রঙ। ঠাকুর দেখা, বেড়াতে যাওয়া, খাওয়া-দাওয়া তো আছেই, পুজোর আনন্দের বড় পাওনা পুজোর সাহিত্য। দুর্গাপুজো উপলক্ষে সাহিত্য রচনার সূত্রপাত ঠিক কবে হয়েছিল, তা আজ আর নিশ্চিত করে বলার কোনো উপায় নেই।  তবে উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে পুজোর সাহিত্যের হদিশ পাওয়া যায়।
একেবারে প্রথম দিকের লেখাগুলি পুস্তিকা আকারে প্রকাশিত হতো। সেই সব লেখার বিষয় মোটামুটি দুটি দিকে ছড়ানো ছিল। দুর্গাপুজো উপলক্ষে ধর্মীয় অনুষঙ্গের রচনা  যদি  একটি দিক হয়, তবে অপরটি ছিল পুজোর আনন্দের প্রেক্ষিতে সামাজিক অবস্থার ছবি। মজার কথা, আশার কথা এই যে, দুর্গাপুজোর সাহিত্যে ধর্ম-কেন্দ্রিক রচনা ক্রমেই কমে এসেছে এবং প্রধান হয়ে দেখা দিয়েছে সামাজিক অন্যায়ের প্রতিবাদ। নগেন্দ্রচন্দ্র গুপ্ত ‘শারদীয় উৎসব’ (১৮৮০) নামে একটি কুড়ি পৃষ্ঠার পুস্তিকা  প্রকাশ করেছিলেন, যেখানে তিনি বলেছিলেন যে সমস্ত ধর্মের মানুষই দুর্গাপূজায় সামিল হতে পারে। ১৮৯৫ খ্রিষ্টাব্দে শশধর তর্কচূড়ামণি ‘দুর্গোৎসব পঞ্চক’ নামে ১১৫ পৃষ্ঠার গ্রন্থে দেখিয়েছেন যে, দেবী দুর্গার প্রকৃত আরাধনা কেমন হওয়া উচিত। এই ধরণের ধর্মীয় আলোচনার কিছু নিদর্শন থাকলেও, সামাজিক বিষয় নিয়েই পুজোর সাহিত্যে চর্চা হয়েছে বেশি।   
        উনিশ শতকে সামাজিক অবক্ষয়ের ছবি পুজোর সাহিত্যে আশ্চর্য ভাবে উঠে এসেছিল। পুজোতে তো মানুষ আনন্দ করে, সকলে মিলিত হয়, তাই লেখকেরা সমাজের মন্দগুলি দেখাবার জন্য এই উৎসবের সময়টিই বেছে নিয়েছিলেন। একটু অদ্ভুত লাগলেও একথা সত্যি, যে নানা সামাজিক অসুখ নিয়ে প্রচুর লেখা পুজোতে প্রকাশিত হয়েছে। সে সময়ে পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুকরণের মোহে অল্প বয়সীদের মধ্যেও নেশা করার প্রবনতা দেখা দিয়েছিল। ১৮৭৮ এ অবিনাশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছিলেন ‘সম্মুখে দুর্গাপূজা এক পয়সা হড্ড মজা’মাত্র দশ পাতার এই পুস্তিকাতে সেকালের শিক্ষিত যুবসমাজ কীভাবে মদ্যপানে নিজেদের ভবিষ্যৎ নষ্ট করছিলেন, তার সরস বর্ণনা আছে। ‘হঠাৎ বাবুর দুর্গোৎসব’ (১৮৮৫) নামে এক অজ্ঞাত-পরিচয় লেখকের পুস্তিকাতে এক মজার বিষয় রয়েছে। হঠাৎ শ্বশুরের সম্পত্তির মালিক হওয়া এক যুবক কেমন করে পুজোতে  কেবল আমোদ-প্রমোদে মেতে উঠছে, তার বর্ণনা করেছেন লেখক। পুজোতে নেশা করার কতটা খারাপ পরিণাম হতে পারে তা এই লেখায় স্পষ্ট। ১৮৯৭ সালে চুনিলাল দেব লিখলেন ‘ফটিকচাঁদ’ নামে এক সামাজিক নক্সা। এই নক্সা হল নাটকের কতকটা লঘু রূপ। এখানেও নেশার নিদারুণ চিত্র ধরা পড়েছে। সে বছর মহালয়াতে এই নক্সাটি অভিনীত হয়েছিল।    
        দুর্গাপুজো নিশ্চয়ই একটি সম্প্রদায়ের মানুষের ধর্মীয় উৎসব। তবে আজ এই পুজোকে কেন্দ্র করে ধর্ম, শ্রেণি নির্বিশেষে মানুষের মধ্যে যে বিপুল উদ্দীপনা দেখা যায় তার সূত্রপাত বোধহয় হয়েছিল উনিশ শতকেই। যখন বাংলার সমাজ, পাশ্চাত্য ভাবধারায় বিকৃতভাবে প্রভাবিত এক দল মানুষের নির্লজ্জ ব্যবহারে শঙ্কিত, তখনই পুজোর আনন্দের মধ্যেও মজার ছলে প্রতিবাদী সাহিত্য রচনা করে দুর্গাপুজোকে এক সামাজিকভাবে সক্রিয় উৎসবের চেহারা দিতে চেয়েছেন সাহিত্যকেরা।  এইভাবে, পুজোর মধ্যে যে ধর্মীয় আবেগ থাকে, তাকে কোনোভাবে আঘাত না করেও উত্সবকে ধর্মীয় বৃত্তের বাইরেও ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব হয়েছিল। চন্দ্রনাথ চৌধুরীর লেখা ‘আগমনী ও দুর্গাপূজার প্যান্টোমাইম’ (১৮৮৩) বইটিতে আগমনী গান আছে; সঙ্গে আছে এক নেশাড়ুর কাহিনি। এমন অদ্ভুত বিষয় নির্বাচন কেন করলেন লেখক? বোধহয় তিনি পুজোর  ধর্মীয় আবহে নেশার ভয়াবহতাকে স্পষ্ট করতে চেয়েছিলেন। আমরা বুঝতে পারছি যে, সেই সময়ে লেখকেরা সমাজের ভালো-মন্দ নিয়ে কতটা ভেবেছিলেন। সেই ভাবনা পুজোর রচনা হিসেবে প্রকাশ পেয়ে বাংলার শারদীয় সাহিত্যের আকাশকে করেছে উদার, বিস্তৃত। পরের সপ্তাহে, দুর্গাপুজোর মজা কীভাবে পুজোর সাহিত্যে উঠে এসেছ, তা নিয়ে গল্প করা যাবে।

(ঋণ স্বীকার :- অধ্যাপক আশিস খাস্তগীর)

Published in Anandabazar Patrika (School Edition) on 04.09.2016.